মানুষের শরীর কি দিয়ে তৈরি? প্রশ্নটি অনেক বড়। সাধারণত বাহ্যিকভাকে আমরা দেখে বুঝে থাকি মানুষের শরীরে হাড়, রক্ত আর মাংস আছে। তবে বাস্তবে এই উপাদানের ভেতরে যে কী আছে তা আমরা খালি চোখে দেখি না।
আমরা যারা বিজ্ঞান পড়েছি বা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানি তারা জানি যে কোন পদার্থের গঠনের মূল হলো পরমাণু। অনেকগুলো পরমাণু মিলে হয় অণু। এক বা একাধিক অণু থেকে সৃষ্টি হয় আমাদের শরীরের বিভিন্ন রকম কোষ।
একেকটি অণু একেকটি যৌগিক পদার্থ যাতে প্রচুর মৌলিক পদার্থ থাকে। তাই সহজেই আমরা বলতে পারি আমাদের শরীরে অনেকগুলো মৌলিক পদার্থ আছে। এগুলো আমরা খালি চোখে দেখি না। মেশিনের সাহায্যেও দেখি না।
এগুলো বুঝার জন্য আমাদের ল্যাবের সাহায্য নিতে হয়। যেখানে আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের নমুনা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা তাতে কি কি উপাদান আছে তা নির্ণয় করা হয়।
মানুষের শরীরে মোট ৬০টি মৌলিক পদার্থ আছে।
মানবদেহ নানা রকমের প্রায় ৭ × ১০২৭টি পরমাণু দিয়ে গঠিত। আরও স্পষ্ট করে বললে, সংখ্যাটি ৭ বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন। আমাদের পরিচিত মোট ১১৮টি মৌল আছে। এর মধ্যে মানবদেহে রয়েছে প্রায় ৬০টি মৌলের উপস্থিতি।
পরমাণুর সংখ্যা এবং মানবদেহের মোট ভরের কতটা কোন পরমাণু দিয়ে গঠিত, তার ওপর ভিত্তি করে উপাদানগুলোকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রধান গাঠনিক উপাদান (ইংরেজিতে বলে, মেইন), মাধ্যমিক গাঠনিক উপাদান (সেকেন্ডারি) এবং অতি সামান্য গাঠনিক উপাদান (ট্রেস)।
প্রধান গাঠনিক উপাদান বলতে বোঝায়, এ উপাদানগুলো মানবদেহে সবচেয়ে বেশি আছে। এই উপাদানগুলো মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। আর মানবদেহে যে উপাদানগুলো প্রধান উপাদানের চেয়ে কম কিন্তু পরিমাণে ঠিক অল্প নয়, সেগুলো মাধ্যমিক গাঠনিক উপাদান।
অতি সামান্য উপাদানগুলো আসলেই মানবদেহে অতি সামান্য পরিমাণে থাকে। এর সবগুলো আবার মানবদেহের ক্রিয়াকলাপের জন্য কাজেও লাগে না। এবার চলুন, উপাদানগুলো সম্পর্কে জানা যাক।
মানবদেহের প্রধান উপাদান চারটি। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন ও নাইট্রোজেন। আমাদের দেহের ৬০ শতাংশই পানি দিয়ে গঠিত। আর পানি গঠিত হয় দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে।
সুতরাং মানবদেহে যে প্রচুর হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হিসেব অনুযায়ী মানুষের শরীরে হাইড্রোজেন বেশি থাকার কথা থাকলেও ভর বেশি হওয়ায় অক্সিজেনের পরিমাণেই বেশি রয়েছে।
তবে ভরের হিসেব না করে পরমাণুর হিসেব করলে মানুষের শরীরে সবচেয়ে বেশি যে মৌলটি পাওয়া যায় তা হলো হাইড্রোজেন। একজন মানুষের শরীরের মোট পরমাণুর ৬২ শতাংশই হাইড্রোজেন। অন্যদিকে অক্সিজেন থাকে ২৪ শতাংশ।
বাস্তবে মানুষের শরীরের মৌলগুলোকে পরমাণুর সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবের চেয়ে ভরের হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও সাধারণভাবে ভরকেই নির্দেশ করা হয়। একজন ৮০-৯০ কেজি ওজনের মানুষের শরীরে মৌলিক পদার্থগুলো যে হারে থাকে তার একটি ধারণা নিচে দেয়া হলো।
- অক্সিজেন: একজন মানুষের শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি পরিমাণ থাকে অক্সিজেন। ৮০-৯০ কেজি ওজনের একজন মানুষের শরীরে অক্সিজেন থাকে প্রায় ৫২ কেজি। জীবের বৃদ্ধি এবং খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তরের কাজ করে অক্সিজেন। তাই আমাদের বেঁচে থাকার জন্য শক্তি দরকার। শক্তি দরকার মানেই হলো অক্সিজেন দরকার।
- কার্বন: কার্বন মানুষের শরীরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একটি মৌলিক পদার্থ। মানুষের শরীরের মোট ভরের প্রায় ১৮ শতাংশই হলো কার্বন। ৮০-৯০ কেজি ওজনের একজন মানুষের শরীরে প্রায় ১৪.৪ কেজি কার্বন থাকে। মেরুদণ্ডের হাড়ে জৈবযৌগ হিসেবে কার্বন রয়েছে।
- হাইড্রোজেন: এটি খুবই পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ মৌল যা আমাদের শরীরে থাকে। আমরা জানি আমাদের শরীরের এক তৃতীয়াংশই পানি। আমরা আরও জানি পানিতে তিন ভাগের দুই ভাগ থাকে হাইড্রোজেন। ওজনে হালকা হওয়ায় মানুষের শরীরে থাকা হাইড্রোজেন ওজনের দিক থেকে তৃতীয়। একজন মানুষের শরীরে ৮ কেজি হাইড্রোজেন থাকতে পারে।
- নাইট্রোজেন: একজন মানুষের শরীরে প্রায় ২.৪ কেজি নাইট্রোজেন থাকে। মানুষের শরীরে যে চারটি মৌলিক পদার্থ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তার মধ্যে নাইট্রোজেন একটি। নাইট্রোজেন ছাড়া মানুষের শরীরে ডিএনএ তৈরি হয় না।
- ক্যালসিয়াম: ক্যালসিয়াম মানুষের শরীরের এক অন্যতম মৌলিক পদার্থ। মানুষের শরীরের হাড় ও দাঁতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে। এটি শরীরের প্রোটিন ও নিয়ন্ত্রণ করে।
- ফসফরাস: একজন মানুষের শরীরে ৮৮০ গ্রাম ফসফরাস থাকে। মানুষের হাড়ে সাধারণত এই মৌলটি পাওয়া যায়।
- সালফার: ৮০-৯০ কেজি ওজনের একজন মানুষের শরীরে প্রায় ২০০ গ্রাম সালফার থাকে। শরীরের সেলুলার সিগন্যালের কাজ সম্পন্ন হয় সালফারের জন্য। শরীরকে ডিডক্সিফািই করে শক্তি উৎপাদনে সালফারের ভূমিকাও কম নয়।
- পটাশিয়াম: পটাসিয়াম এমন একটি খনিজ যা শরীরের সব কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি শরীরের স্নায়ু এবং হৃদপেশীকে ভালভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও কোষে জমে থাকা বর্জ্য অপসারণেও ভূমিকা রাখে। মানুষের শরীরে ২০০ গ্রাম পটাশিয়াম থাকে।
- সোডিয়াম: সোডিয়াম মানব শরীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরের রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সঠিক মাত্রার সোডিয়াম আসল ভূমিকা পালন করে। শরীরের তরল উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সোডিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের শরীরে ১২০ গ্রাম সোডিয়াম থাকা দরকার।
- ক্লোরিন: একজন সুস্থা ও স্বাভাবিক মানুরে শরীরে ১২০ গ্রাম ক্লোরিন থাকে। আমাদের পেটে হাইড্রোক্লোরিক এসিড আকারে ক্লোরিন পাওয়া যায়। শরীরে পানি ও লবণের ভারসাম্য বজায় রাখে ক্লোরিন।
- ম্যাগনেশিয়াম: ম্যাগনেশিয়াম মানুষের বিপাকে সাহায্য করে। এছাড়া হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায় ম্যাগনেশিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের শরীরে ৪০ গ্রাম ম্যাগনেশিয়াম থাকে। পেশী এবং স্নায়ুর কার্যকারিতায় ভূমিকা রয়েছে ম্যাগনেশিয়ামের।
- আয়রন: মানুষের শরীরে হিমোগ্লোবিন আকারে আয়রন বা লোহা বিরাজ করে। একজন মানুষের শরীরে ৪.৮ গ্রাম আয়রন থাকে। অনেক এনজাইমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আয়রন যা বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সহজ করে। এর ফলে কোষের কার্যকারিতা বাড়ে।
উল্লেখিত মৌলগুলো ছাড়াও ফ্লোরিন ৩ গ্রাম, জিঙ্ক ২.৬ গ্রাম, স্ট্রনশিয়াম ০.৩৭ গ্রাম, আয়োডিন ০.০১২৮ গ্রাম, কপার ০.০৮ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ০.০১৩৬ গ্রাম এবং মলিবডেনাম ০.০১০৪ গ্রাম পরিমাণে থাকে।
মানুষের শরীরে কিছু কিছু মৌল আছে যেগুলো খুবই অল্প পরিমাণে থাকে যা বিশেষ কোন উপকারে আসে না। আবার এগুলো বিশেষ কোন ক্ষতিও করে না। অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম, সিজিয়াম ও রূপার মতো মৌলগুলোর শরীরে বিশেষ কোন ভূমিকা নেই।
তবে লোহা, দস্তা, তামা, আয়োডিন, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লিথিয়াম, মলিবডেনাম এবং কোবাল্টের মতো মৌলগুলো শরীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো পরিমাণে কম থাকলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আয়রন শরীরের রক্তে অবস্থান করে কোষে কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে যা একান্তই প্রয়োজন।
অপরদিকে সীসা, অ্যান্টিমনি, থ্যালিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম ও রেডিয়ামের মতো মৌলগুলো খুবই সামান্য পরিমাণে থাকলেও তা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
মানুষের শরীরের জৈবরাসায়নিক কার্যক্রমে এই মৌলগুলোই প্রধান ভূমিকা রাখে। যা শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য দায়ী। তাই এগুলোর পরিমিত মাত্রার কম বা বেশি যদি শরীরে বিরাজ করে তবে তা আমাদের শরীরের উপকার বা ক্ষতির কারণ হতে পারে।